Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

জেলার পটভূমি

বিস্তারিত জেলার পটভূমি



তাড়াশ জমিদার                                                                              ভবনজোড় বাংলা মন্দির

‘পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। এক কিংবদন্তি মতে গঙ্গার ‘পাবনী’ নামক পূর্বগামিনী ধারা হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। অপর একটি সূত্রে জানা যায় ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় পাবনা নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মিলে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে চৌদ্দজন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন -এঁদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত। আবার অনেকের মতে পৌন্ড্রবর্ধন হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁরা বলেন পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুন্ড্রুবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধন রূপে উচ্চারিত হতে হতে পাবনা হয়েছে।

সাবেক পাবনা (সিরাজগঞ্জ জেলাসহ) জেলা রূপে গঠিত এলাকাটি প্রাচীন যুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ ও পুন্ড্রুবর্ধন জনপদের অংশ ছিল। গঙ্গারিডির রাজত্বের অবসানের পর বৃহত্তর পাবনা মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাজা অশোক পুন্ডুসহ সমগ্র বাঙলা নিজ শাসনাধীনে এনেছিলেন। জেলাটির প্রায় সম্পূর্ণই মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। মৌর্য বংশের পতনের পর পাবনা জেলাসহ বাংলার এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থার ইতিহাস অজ্ঞতার অন্ধকারে চাপা পড়ে যায়। এ অঞ্চল সমুদ্রগুপ্তের সময়ে (৩৪০-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ) গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং প্রথম কুমার গুপ্তের (৪১৩-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে পাবনা (সিরাজগঞ্জসহ) জেলা উত্তর বাংলার পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি নামে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগে পরিণত হয়েছিল। গুপ্ত রাজাদের পতনের পর এই অঞ্চল খুব সম্ভবতঃ পরবর্তী গুপ্তদের অধীনে মহাসেন গুপ্তের রাজত্বকাল পর্যন্ত শাসিত হয়েছিল। তিনি ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে বাংলার এ অংশে রাজত্ব করেছিলেন। সপ্তম শতকের প্রারম্ভে শশাংক পরবর্তী গুপ্তদের উচ্ছেদ সাধনে সাফল্য অর্জন করেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং মগধ নিয়ে গৌড় রাজ্য নামেএকটি স্বাধীন শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। ৬৩৭ খ্রিঃ শশাংকের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন এই অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। এ সময়ে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চীন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশ পরিভ্রমণে আসেন। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রাচীন বাংলার এ অংশের প্রায় দেড়শত বছরের ইতিহাস অজানার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। এ সময়ে (৬০০-৭৫০ খ্রিঃ) বাংলায় রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। কেন্দ্রে কোন শাসন ছিলনা। এক চরম অরাজক অবস্থা। ইতিহাসে এ সময়কে মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অষ্টম শতকের প্রারম্ভে ৭২৩ এবং ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে কনৌজের যশোবর্ধন গৌড়রাজকে পরাজিত করে বাংলাদেশ দখল করেন এবং পাবনা জেলাসহ প্রায় সমগ্র বাংলা তাঁর হস্তগত হয়। ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যলোবর্ধনকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের উর প্রভুত্ব বিস্তার করে। পরবর্তীকালে পাবনা পালদের অধীনে এসে যায়।



পাল বংশের (আনুমানিক ৭৫৮-১১৬২ খ্রিঃ) অন্তত ১৭ জন রাজা তাদের স্ব-স্ব রাজত্বকালে পাবনার উপর কর্তৃত্ব করে গিয়েছিলেন। রাম পালের মৃত্যুর পর (১১২৫ খ্রিঃ) পাল রাজবংশের অস্তিত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা পর্যায়ে সেন বংশের রাজাগণ এ অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পালদের পতনের যুগে চালুক্য যুবরাজ ৬ষ্ঠ বিক্রমাদিত্য যখন বাংলা আক্রমন করেন সম্ভবত তখন সেনরা দক্ষিণ ভারত থেকে তার সংগে এখানে আগমন করেন। প্রথমে তারা পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর রামপালের রাজত্বকালে উত্তর বাংলায় স্বাধীন রাজত্বের সূচনা করেন। সেন বংশের প্রথম প্রসিদ্ধ রাজা বিজয় সেন শেষ পাল রাজা মদন পালকে পরাজিত করেন। তাঁর রাজত্বকালে পাবনা অধিকারে আসে। তিনি রামপুর গোয়ালিয়া থেকে ৫ মাইল পশ্চিমে গোদাগাড়ীর সন্নিকটে বিজয় নগরে রাজধানী স্থানান্তর করেন।

লক্ষণ সেনের(সেন রাজবংশের শেষ রাজা) রাজত্বের শেষ ভাগে সেন রাজ্যের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। এই সময় ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমন করেন এবং লক্ষণাবতী অধিকার করে নেন। ঐ সময় পাবনা জেলা মুসলমানদের অধিকারে আসে। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে তার নব বিজিত রাজ্য শাসন করেন।



১২০৫ সাল হতে পাবনা জেলা গৌড়ের মুসলিম শাসকদের অধিকারে ছিল। ১২০৬ সালে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পর মুহম্মদ সিরাণ খলজি এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন উপাধি ধারণপূর্বক তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। অতঃপর দিল্লীর সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের নিকট থেকে আলী মর্দান লক্ষণাবতীর রাজ প্রতিনিধিত্ব লাভ করেন। ১২১০ সালে কুতুব উদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর আলী মর্দান দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং সুলতান উপাধি ধারণ করেন। প্রায় তিন বৎসর কাল তিনি এ জেলার উপর তার শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। তিনি খলজি আমীরগণের হাতে ১২১২ সালে নিহত হন। এই আমীরগণ অতঃপর লাখনৌতির শাসনকর্তা হিসেবে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজীকে মনোনীত করেন। তিনি সুলতান উপাধি ধারণপূর্বক প্রায় ১৪ বৎসর রাজ্য শাসন করেন। অতঃপর ১২২৭ সালে সুলতান ইলতুতমিশের পুত্র যুবরাজ নাসির উদ্দিনের হাতে সুলতান গিয়াস উদ্দিন নিহত হলে যুবরাজ নাসির উদ্দিন লাখনৌতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২২৭-১২৮২ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ জন শাসনকর্তা লাখনৌতির শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ঐ সময়ে লক্ষণাবতীর কোন শাসনকর্তাই দিল্লীর সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করেননি। সুলতান মুগিস উদ্দিন তুঘরিল ১৬ জন শাসনকর্তাদের মধ্যে শেষ ব্যক্তি ছিলেন। তখন দিল্লীর সুলতান ছিলেন গিয়াস উদ্দিন বলবন। তিনি লক্ষ্মণাবতীর শাসনকর্তার আনুগত্য বরদাস্ত করতে পারেননি। তাঁকে দমন করার জন্য তিনি বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে ১২৮২ সালে তুঘরিল পরাজিত ও নিহত হলে সুলতান বলবন তদীয় পুত্র বোগরা খানকে লাখনৌতির শাসনকর্তা নিয়োজিত করেন। পরবর্তী সময়ে বোগরা খাঁন দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সুলতান নাছির উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করেন। ১৩২৪ সাল পর্যন্ত লাখনৌতির স্বাধনীতা অক্ষুন্ন থাকে। ঐ বৎসর দিল্লীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক লাখনৌতিকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে নেন।



দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকের (১৩২৫-১৩৫১ সাল) রাজত্বের পতনোত্তর সময়ে জনৈক হাজী ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহন করেন। নিঃসন্দেহে পাবনা জেলা হাজী ইলিয়াস শাহের (১৩৪২-১৩৫৭) রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় উত্তরাধীকারী সিকান্দার শাহ, সায়ফুদ্দিন হামজা শাহ, শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ প্রভৃতি নরপতিগণ এ জেলার উপর তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন।



অতঃপর রাজা গণেশ ১৪১৪ সালে লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। শীঘ্রই তাঁর মৃত্যু ঘটায় রাজত্বকাল স্বল্পস্থায়ী হয়। অতঃপর তদীয় উত্তরাধিকারী ও পুত্র যদু ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ও জালাল উদ্দিন নাম গ্রহণ করেন। জালাল উদ্দিন ১৪৩২ সাল পর্যন্ত এই জেলার উপর তাঁর শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। তারপর তদীয় পুত্র সামছুদ্দিন আহমদ শাহ ১৪৪২ সাল পর্যন্ত এই এলাকা শাসন করেন। উক্ত সামছুদ্দিন আহমদ শাহকে হত্যা করে জনৈক নাসির উদ্দিন আবুল মোজাফফর মাহমুদের মাধ্যমে ইলিয়াসশাহী রাজ বংশ পুনঃ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত এ জেলা উক্ত ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শাসনাধীনে ছিল। অতঃপর ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভ্রান্তি ও বিশৃংখলা বিরাজ করছিল। এ সময়ে আবিসিনীয় অধিবাসীরা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মাধ্যমে ইলিয়াসশাহী রাজবংশকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। এদের শেষ রাজা সামছুদ্দিন মোজাফফর শাহ (১৪৯১-১৪৯৩) তদীয় উজির সাঈদ হোসেন কর্তৃক নিহত হলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি ধারণ করে ১৪৯৩ সালে তিনি লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ জেলা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনাধীনে ছিল। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ ১৫৩৮ সাল পর্যাপ্ত এই জেলার উপরে তাদের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে এ অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে এবং দেশে সুশাসন কায়েম হয়। এ সময়ে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বিস্তৃতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধির ঘটে।



অতঃপর দিল্লীর সুলতান শের শাহ শুরী(১৫৩৯-১৫৪৫ সাল) কর্তৃক বাংলা বিজয়ের ফলে ১৫৩৮ সালে হোসেন শাহী রাজবংশের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর শেরশাহের মৃত্যুর পর ইসলাম শাহ(১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিঃ) এ জেলার উপর তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর বাংলার শাসনকর্তা শুর বংশীয় মাহমুদ খান শুর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সামছুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ গাজী (১৫৫৩-১৫৫৬ সাল) উপাধি ধারণ করে পাবনা জেলায় তাঁর শাসন ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দিন বাহাদুরশাহসহ তদীয় উত্তরাধীকারগণ ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত এ জেলার উপর তাদের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে তাজ খান কররানী লাখনৌতির সিংহাসন দখল করলে পাবনা জেলা তার শাসনাধীনে চলে যায়। এভাবে ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত দাউদ কররানী এ জেলার কর্তৃত্ব করেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের নিকট পরাজিত ও নিহত হন এবং ১৫৭৬ সালে লাখনৌতি বা গৌড়রাজ্যে মুঘল শাসনের সূচনা ঘটে। পাবনা জেলা এ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত থাকায় তা ঐ একই বছর মুঘল শাসনাধীনে এসে যায়।

১৫৭৬-১৭২৭ সাল পর্যন্ত দিল্লীর মুঘল সম্রাজ্যের অধীনে ২৯ জন শাসনকর্তা এ জেলার উপর তদের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন রাজা মানসিংহ, ইসলাম খাঁ, শাহজাদা মুহম্মদ সুজান, মীর জুমলা, নবাব সায়েস্তা খাঁ, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ। সুদীর্ঘ মুঘল শাসনাধীন সময়ে পাবনা জেলায় শান্তি ও প্রগতির এক নুতন যুগের সূচনা হয়।

নবাব মুর্শিদকুলী খানের (১৭০০-১৭২৭ সাল) অধীনে কার্যতঃ বাংলা স্বাধীন হয়। তিনি কঠোর রাজস্বনীতি অবলম্বন করেন। এর ফলে পূর্ববর্তী আমলের জমিদারগণ রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের জমিদারী কেড়ে নিয়ে নবাবের অনুগ্রহ ভাজনদের মধ্যে বিলি করা হয়। এভাবে উত্তরাধীকারী সূত্রে রাজা হওয়ার পরিবর্তে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয় এবং বাসতবিক পক্ষে সমসত বাংলার মধ্যে এই জেলার রাজাদের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন নাটোর রাজ। নাটোর রাজার পরিবারের সদস্যগণ বরেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণদের মৈত্র পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত পদ্ধতিতে নবাব মুর্শিদকুলী খানের দেওয়ান থাকা অবস্থায় ১৭০৭ সাল থেকে এ সকল জমিদারি নাটোর রাজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাম জীবনকে প্রদান করা হয় এবং তিনি ১৭৩০ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন। এতে পাবনা জেলা অন্তর্ভূক্ত ছিল।



১৭২৭-১৭৩৯ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা তৎকালীন সুবেদার নবাব সুজা উদ্দিনের শাসনাধীনে ছিল এবং রাজশাহীর জমিদারির রাজস্ব শাসন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন রাম জীবন। ১৭৩০ সালের পর রাম জীবনের উত্তরাধিকারী মহারাজ রামকান্তের উপর রাজস্ব শাসন ব্যবস্থা অর্পিত হয়। আলীবর্দী খাঁ ১৭৪২-১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন। মহারাজ রামকান্তের মৃত্যুর পর এ বিশাল জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব রানী ভবানীর উপর এসে পড়ে। এই প্রতিভাময়ী মহিলা পলাশী, উদয় নালা, বকসার যুদ্ধ এবং লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসন ও অষ্টাদশ শতকের বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোকক্ষয়কারী মহাদুর্ভিক্ষের অরাজকতা পূর্ণ সময়ে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী কালব্যাপী দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে এই বিশাল জমিদারির শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন।

আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে পাবনা জেলা মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তদীয় দৌহিত্র উত্তরাধিকারী নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা বাংলা সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং এক বছরকাল পাবনা জেলাসহ সমগ্র বাংলার শাসন ক্ষমতা বজায় রাখেন। ১৭৫৭ সাথে তাঁর রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং এই সংগে শেষ হয় বাংলার স্বাধীন মুসলিম রাজত্ব। ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে বাংলায় তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার দেওয়ানী লাভ করে। অথচ রাজশাহীর জমিদারির রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থায় কোনরূপ হসতক্ষেপ করা হয়নি। পাবনা জেলা প্রধানতঃ রাজশাহীর জমিদারির অন্তর্ভূক্ত থাকায় একমাত্র রানী ভবানীই কোম্পানীকে এর ভূমি রাজস্ব প্রদানের জন্য দায়ী ছিলেন। জেলার একাংশ অবশ্য বড়বাজু ও কাগমারী জমিদারির অন্তর্ভূক্ত ছিল যা বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। সিরাজগঞ্জ জেলার বৃহত্তর অংশ নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭০৩-১৭২৬ সাল) বড়বাজু ও কাগমারী জমিদারির অংশ ছিল।



অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিট্রিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক ও কারিকরদের বিদ্রোহ ঘটে। সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ ‘‘ফকির ও সন্নাসী’’ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলার ফকির সম্প্রদায়ের দলপতি শাহ মস্তান বোরহানা উত্তর বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিট্রিশ বিরোধী কাজে তৎপর ছিলেন। এ সময় সিরাজগঞ্জের নিকটে ফকিররা খুবই তৎপর ছিল। মজনু শাহ ১৭৮৭ সালে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত পাবনা ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে (রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ) তৎপর ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় জেলার বেশিরভাগ অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বাংলার এই অংশে প্রধানতঃ বহু সংখ্যক ডাকাত দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকায় ১৮২৮ সালে এটিকে একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসাবে গঠন করা হয়। আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং অধিবাসীদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পাবনায় সাময়িকভাবে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় ১৮২৮ সালে। ১৮৩২ সালে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগ স্থায়ী করা হয় এবং এই সময় তাঁকে একজন স্বতন্ত্র ডেপুটি কালেক্টর রূপে নিযুক্তি প্রদান করা হয়। স্বতন্ত্র জেলা সৃষ্টির প্রাক্কালে রাজশাহীর পাঁচটি থানা আলাদা করে জেলাটি গঠিত হয়। এসব থানা ছিল রাজশাহী থেকে ক্ষেতপাড়া, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, মত্থরা ও পাবনা এবং যশোরের ৪ টি থানা। ১৮৪৮ সালে জেলার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত হিসাবে যমুনা নদীকে স্থির করা হয় এবং এ নদীর গতি ধারায় পরিবর্তনের দরুন ১৮৫৫ সালে সিরাজগঞ্জ থানাটি ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে পাবনার সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৮৫৯ সালে একজন ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর রাখার বর্তমান পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং একই সময়ে এতকাল যাবত পাবনার অংশ হিসেবে পরিগণিত পাংশা, খোক্সা ও বালিয়াকান্দি এই তিনটি থানা নিয়ে স্বতন্ত্র ‘‘কমরকলি’’ (কুষ্টিয়া কুমারখালী) মহকুমা গঠন করা হয়। পদ্মার দক্ষিণে এক বিরাট ভূখন্ড তখনও এ জেলার অধীন ছিল। ১৮৬০ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়ার সংগে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৭১ সালে পাবনা থেকে পাংশা থানা ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমার এবং কুমারখালী থানা নদীয়ার কুস্টিয়া মহকুমার সাথে সংযুক্ত করা হয়। এভাবে জেলার দক্ষিণ সীমানা পদ্মা নির্ধারিত হয়।

ঊনিশ শতাব্দির ফরায়েজী ও তারিকৎ-ই-মুহাম্মদীয়া আন্দোলন দুটির দ্বারা পাবনা জেলার অধিবাসীগণ ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত হয়। ১৮১৮ সালে ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তারিকৎ-ই-মুহাম্মদী আন্দোলন সৈয়দ আহমেদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ কর্তৃক সূচিত হয় ১৮১৮ সালে। ১৮২০ সালে সৈয়দ আহমেদ শহীদ কলকাতা সফর করেন এবং অসংখ্য লোক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে তারিকৎ-ই-মুহাম্মদীয়া আন্দোলনের প্রভাব পাবনা জেলাসহ বাংলার অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।



১৮৫৭ সালে ভারত বর্ষের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে(ইংরেজের চোখে সিপাহী বিদ্রোহ) এই জেলা নীরব ছিল। এই জেলার মধ্য দিয়ে ঢাকার বিদ্রোহীদের উত্তর বাংলায় গমন পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পাবনা জেলার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ রেভেন্স জেলার নীলকর সাহেবগণকে সৈন্যদল গঠন করতে নির্দেশ দেন। এই বিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের অবসান ঘটে তখন স্বভাবতঃই পাবনা জেলা ১৮৫৮ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনাধীনে চলে যায়।



ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সমগ্র পাবনা জেলাব্যাপী নীলের চাষ ও নীল তৈরীর কাজ ব্যাপকভাবে চালানো হয়। নীলচাষ চাষিদের নিকট কখনো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। কেননা জমিদারগণ এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং নীলের জমির উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে রায়তদের লাভ করার আশা নির্মূল করে দিতেন। এই জেলার নীলকরদের পীড়ন নীতির ফলে কৃষকরা ১৮৫৯-৬০ সালে বিদ্রোহ করে। ফলে নীলের চাষ ও নীল তৈরীর কাজ নীল চাষিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। নীল বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনয়ন করে। দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য জেলায় জেলায় কালেক্টরের পদ সৃষ্টি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। মিঃ জি ব্রাইট এই জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর নিযুক্ত হন।



১৮৭২-৭৩ সালে পাবনা জেলায় ভূ-সম্পত্তি সংক্রান্ত গোলযোগ দেখা দেয় এবং তা কৃষক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৫ সালে বেংগল টেনান্সি এ্যাক্ট জারির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাসহ এই জেলায় কৃষক আন্দোলন স্তিমিত হয়। লর্ড কার্জনের শাসনামলে (১৮৯৯-১৯০৫ সাল) বঙ্গ ভঙ্গের ফলে পাবনা জেলা নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা ও আসামের সংগে যুক্ত হয়। অবশ্য ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট তারিখে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটায় এই জেলা (সিরাজগঞ্জসহ) পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণের মনে পাকিস্তানের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শাসক সম্প্রদায়ের বৈষম্য ও শোষণমূলক নীতি ও আচরণের ফলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। তাছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ পুর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে সমস্ত পাকিস্তানের জন্য একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার ফলে পুর্ব বাংলার তরুণ, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবি সমাজ পাকিস্তান সরকারের এই একতরফা ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাডাঁয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবী আদায়ের জন্য বাঙালিরা স্বাধীকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালির এ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় এক দীপ্ত ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলনের একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকে পাবনাবাসীও একাত্ব হয়ে যায়,। পাবনার জেলা ও থানায় থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৩ মার্চ পাবনার টাউন হলে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। পরপরই পতাকা উত্তোলিত হয় জেলা প্রশাসকের বাসভবনে।

জেলা প্রশাসক জনাব এম নূরুল কাদের খান মুক্তিকামী জনতার জন্য পুলিশ লাইনের অন্ত্র ভান্ডার খুলে দিয়ে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হবার আহবান জানান। ২৬ মার্চ রাতে পাক সেনারা বিসিক শিল্পনগরীতে ঘাটি করে এবং টেলিগ্রাফ অফিস, সার্কিট হাউজ, স্টেডিয়াম, ডাকবাংলো দখলে নেয়। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পাকসেনারা পুলিশ লাইন আক্রমন করে। ব্যারাকের পুলিশ সদস্যরা গড়ে তোলে প্রতিরোধ। তাদের সাথে যোগ দেয় জেল পুলিশ। শহরের মুক্তিকামী জনতার সাথে প্রতিরোধে অংশ নেয় চরাঞ্চল এবং গ্রাম অঞ্চল থেকে আশা হাজার হাজার মানুষ। টেলিগ্রাফ অফিসসহ বিভিন্ন স্থানের প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ২৮ মার্চ পাকসেনারা পালিয়ে যায় রাজশাহীতে। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা ছিল স্বাধীন। বাংলাদেশের মানচিত্রে সম্মুখ সমরে প্রথম শত্র্রু অবমুক্ত জনপদ হওয়ার দূর্লভ গৌরব অর্জন করে পাবনা। ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশর পতাকা উত্তোলিত হয়। ১১ এপ্রিলে পাকসেনারা আবার চলে আসে পাবনাতে। জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ হয়, অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তথ্য প্রবাহের সুযোগ না থাকায় এবং ১৭ তারিখ পর্যন্ত পাকসেনারা দখলরত থাকায় পাবনা শত্রুমুক্ত হয় ১৮ মার্চ।